নয়া দিল্লি, ১৫ এপ্রিল ২০১৭ (বাসস) : ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) চলমান আসরের ধারাভাষ্যকার হিসেবে বর্তমানে ভারতে আছেন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক। ধারাভাষ্য দেয়ার মাঝেই বর্তমান ক্রিকেটের পরিস্থিতির সাথে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেট পার্থক্য, কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজের পাশাপাশি নিজের বর্তমান অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললেন ক্লার্ক। তার সেই সাক্ষাৎকারের অংশ তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আইপিএলের কমেন্ট্রি বক্সের অভিজ্ঞতা ?
মাইকেল ক্লার্ক : দুর্দান্ত, অসাধারন। এবি ডিভিলিয়ার্স-বিরাট কোহালি-ক্রিস গেইলদের মতো ব্যাটসম্যানকে লাইভ দেখতে পারাটা একটা বিরাট প্রাপ্তি। আমি তো বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি এখনকার ক্রিকেটারদের কান্ডকারখানা দেখে! কারও স্ট্রাইক রেট ১৬০! কারও ১৮০! কারও আবার ২২০! আমি দেখছি আর ভাবছি, হচ্ছেটা কী এসব। আমরা কি দু’শো বছর আগে ক্রিকেট খেলতাম নাকি? আমাদের সময়ে তো ৯০ বা ১০০ স্ট্রাইক রেট থাকলেই বলা হতো, এ বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান। তখন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বা ম্যাথু হেইডেনকে দেখে আমরা বলাবলি করতাম, কী পেটায় রে বাবা! এখনকার ব্যাটসম্যানরা যেটা করছে, সেটা ¯্রফে অবিশ্বাস্য। খেলার খুবই উন্নতি হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দর্শকদের বিনোদন বেড়ে গিয়েছে। এই কারণে দর্শক বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে আইপিএলের অবদান স্বীকার করতেই হবে।
প্রশ্ন : আইপিএল খেলেছেন মাত্র একটা মৌসুম। তাও অল্প কিছু ম্যাচ। অথচ, ধারাভাষ্যকার হিসেবে সব ম্যাচে হাজির। কী মনে হয়, খেলাটাকেই বদলে দিয়েছে আইপিএল?
মাইকেল ক্লার্ক : আমি অনুশোচনায় ভুগি না। আইপিএল খেললাম না বলে দুঃখ নেই। আইপিএল খেলাটাকেই শুধু বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে ভাল’র জন্য। এখন যে গতিতে তরুণ ক্রিকেটারেরা উঠে আসছে, সেটা সম্ভব হচ্ছে ¯্রফে আইপিএলের জন্য। আমি যখন খেলছিলাম, তখনও প্রধান ফরম্যাট ছিল টেস্ট ক্রিকেট। তার সঙ্গে ছিল ওয়ানডে। বিশ্বকাপের জন্য সেটাও খুব বড় ফরম্যাট। টি-টোয়েন্টি তখন সবে শুরু । তাই খুব বেশি খেলার সুযোগ হয়নি আমার। এখন ভাবলে মনে হয়, ইয়েস, এখন ক্রিকেট খেললে আইপিএল খেলতে আমি খুবই আগ্রহী হতাম। পারলাম না বলে অনুশোচনা নেই। কিছুটা হতাশা আছে। অনুশোচনা হয় না কারণ আমার সময়কার সেরা দু’টো ফর্ম্যাটে আমি সেরাটা দিতে পেরেছি।
প্রশ্ন : কিন্তু ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা যে বলে থাকেন, টি-২০ মানেই ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট। টি-২০ ক্রিকেটের জন্য টেস্টর ক্রিকেট ধ্বংস হয়ে যাবে!!!
মাইকেল ক্লার্ক: এই বিশ্লেষনটা কখনও আমার মাথাতে ঢুকল না। আমি তো দেখছি, যারা টি-২০র সেরা ক্রিকেটার তারাই ওয়ানডের সেরা, তারাই আবার টেস্ট ক্রিকেটকে শাসন করছে। আমি তিনটে নাম বলছি। এবি ডিভিলিয়ার্স, বিরাট কোহালি, স্টিভ স্মিথ। এরাই তো ব্যাটিংয়ে টপ থ্রি। যেমন পাঁচ দিনের টেস্টে, তেমনই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। এবি সেদিন যখন দুর্ধর্ষ ইনিংসটা খেলছিল, আমি কমেন্ট্রি করছিলাম। আমি বলেছিলাম, টি-টোয়েন্টিকে অনেকে ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট বলে। কিন্তু এখানে এবি-র ব্যাটিংয়ে যে টেকনিক দেখতে পাচ্ছি, সেটা দেখার জন্য সহ¯্র মাইল হেঁটে আসতেও আমি রাজি।
প্রশ্ন : তরুন ক্রিকেটারদের উদ্দেশে আপনার উপদেশ কী হবে?
মাইকেল ক্লার্ক: টেকনিকের দিকে মন দাও। ওটাই হল আসল ভিত। ব্যাটিং জিনিসটা হল বাড়ি বানানোর মতো। প্রথম লক্ষ্য শক্ত ভিত তৈরি করা। তোমার ভিত যদি শক্ত হয়, পঁচিশ তলা বাড়িও বানাতে পারবে, পাঁচ তলাও পারবে। কারও টেকনিক ভাল হওয়া মানে সে সব ধরনের ক্রিকেটে সফল হবে।
প্রশ্ন : টেকনিক থাকার পরও তিন ধরনের ক্রিকেটে কী করে উন্নতি করবে?
মাইকেল ক্লার্ক : একটা একটা করে ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নিজেকে। টেকনিকটা ভিত করে নানা রকম স্কিল আয়ত্ব করতে হবে। তিন ধরনের ক্রিকেটে তিন রকম মানসিকতা থাকতে হবে। টি-টোয়েন্টি খুব আক্রমণাত্মক একটা ফরম্যাট। সেটার জন্য খুব আগ্রাসী মনোভাব রাখতে হবে। ওয়ানডেতে একটু ধরে খেলার সুযোগ থাকে। টেস্টের জন্য মাথায় রাখতে হবে যে, দীর্ঘক্ষণ ব্যাট করাটাই আসল। আমার কাছে পারফেক্ট ক্রিকেটার হল সে-ই যে সব ধরনের ফর্ম্যাটে সফল হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রশ্ন : ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে স্লেজিং নিয়ে এত তীব্রতা, এত তিক্ততা হল, এটা কি সমর্থনযোগ্য?
মাইকেল ক্লার্ক: আমার মনে হয়, মিডিয়া ব্যাপারটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত তো দেখলাম, লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছে দু’দেশের মিডিয়ার মধ্যে। আমি তো সে দিন কমেন্ট্রি করতে গিয়েও বললাম, যাদের স্লেজিং নিয়ে এত কথা ওঠে, তারা সবাই এখন আইপিএলে বিভিন্ন দলের অধিনায়ক। স্টিভ স্মিথ, বিরাট কোহালি, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, রোহিত শর্মা। এরা যখন দেশের হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়বে, এক ইঞ্চি ছেড়ে দেবে না। তখন পরস্পরের দিকে তেড়ে যেতে দেখা যাবে। আর সেটাই তো হওয়া উচিত। আমার কাছে খেলার মন্ত্রটাই তো সেটাই- মাঠে নামব জেতার জন্য। অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে আপস করা যাবে না। তা বলে কি সেই তিক্তটাই মনে রাখব নাকি? বিরাট যতই বলুক, ও নিজেও মনে রাখার ছেলে নয়। ওরা ঠিকই মাঠের বাইরে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলবে।
প্রশ্ন : আপনি কি নিশ্চিত, আবার খেলতে নামলে কোহলি-স্মিথরা স্বাভাবিক থাকতে পারবে?
মাইকেল ক্লার্ক : সবাই মনে রাখবে স্কোরলাইনটাই। ভারত ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছিল। আমাদের দেশে বলাবলি হবে যে, অস্ট্রেলিয়ার তরুণ একটা টিম দারুণ লড়েছিল। হেরে গেলেও মাথা উঁচু করে ফিরেছিল। এরপর ভারত হয়তো পরের গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়ায় আসবে। তখন আবার ফাটাফাটি ক্রিকেট হবে। তখন আবার কেউ কাউকে ছাড়বে না। আমি আশা করব, ক্রিকেট ভক্তরা দু’টো দারুণ টিমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করবে। খুব হাড্ডাহাড্ডি সিরিজ হবে আবার, তবে সিরিজটা শেষ হয়ে গেলে কোহলি-স্মিথ আবারও বন্ধু হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : এবারের আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সকে কেমন দেখছেন?
মাইকেল ক্লার্ক : খুবই ভালো। আমি কেকেআরের ম্যাচেই বেশি কমেন্ট্রি করছি বলে ওদের টিমটা খুঁটিয়ে দেখছি। ক্রিস লিনের জন্য আমার খারাপ লাগছে। ওর সঙ্গে গৌতম গম্ভীরের ওপেনিং জুটি তৈরি করাটা এ বারে কেকেআরের মাস্টারস্ট্রোক ছিল। আমার মনে হয়েছিল, এই আইপিএলে সেরা ওপেনিং কম্বিনেশন ওটাই ছিল। গম্ভীর আর লিন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ছেলেটার, চোট লেগে বাদ পড়লো। আমার মনে হয় নাইট রাইডার্স ও সানরাইজার্স হায়দারাবাদ এ বারের আইপিএল জেতার ব্যাপারে দু’টো ফেভারিট টিম।
প্রশ্ন : কেকেআরে কোন খেলোয়াড়কে আপনার ভালো লাগে?
মাইকেল ক্লার্ক : অধিনায়ক গম্ভীরকে। দারুণ একটা ছেলে। খুব ভাল ব্যাটসম্যান আর দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন। কেকেআরের স্পিন বিভাগটাও আমার খুব ভাল লাগে। খুব শক্তিশালী স্পিন বিভাগ ওদের।